দ্রুত ব্রণ দূর করার ঘরোয়া উপায় ও আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতি:
ত্বকের বহুল পরিচিত একটি সমস্যা হলো ব্রণ। ত্বকের কোশের ভেতরে এই ব্রণগুলো তৈরি হয়। ব্রণ ত্বকের একটি দীর্ঘমেয়াদী রোগ। সাধারণত মুখমন্ডলে এই ব্রণ সৃষ্টি হয়। তবে কারো কারো ক্ষেত্রে বুক ও পিঠে এই ব্রণ দেখা যায়। আজ দ্রুত ব্রণ দূর করার উপায় সম্পর্কে আলোচনা করবো।
দ্রুত ব্রণ দূর করার ঘরোয়া উপায়:
১. মুলতানি মাটি দিয়ে ব্রণ দূর করার নিয়ম-
দ্রুত ব্রণ দূর করার কার্যকর উপায় হলো মুলতানি মাটির ব্যবহার। মুলতানি মাটি আমাদের ত্বকের তেল জাতীয় পদার্থ দ্রুত শুষে নেয়। জলের সাথে মুলতানি মাটি মিশিয়ে ব্রনের কাছে ১৫ থেকে ২০ মিনিট লাগিয়ে রাখুন। তারপর ঠান্ডা জল দিয়ে ধুয়ে ফেলুন। কয়েকদিনের মধ্যেই ব্রণ ও ব্রণের দাগ দূর হয়ে যাবে।
২. শশা-
শশা আমাদের ত্বক খুব দ্রুত শুষ্ক করে দেয়। ফলে তেল জাতীয় পদার্থ আমাদের লোমকূপে জমতে পারে না এবং ব্রণ দূর হয়।
৩. ব্রণ দূর করতে কাঁচা হলুদ ও চন্দনের গুঁড়ো-
মুলতানি মাটির সাথে কাঁচা হলুদ ও চন্দনের গুঁড়ো মিশিয়ে ব্রনের দাগের ওপর নিয়মিত ব্যবহার করলে ব্রণ ও ব্রণের দাগ দূর হবে।
৪. ব্রণের জন্য নিম পাতার ব্যবহার-
নিমের অ্যান্টি-ব্যাকটেরিয়াল গুণ রয়েছে। তাই দ্রুত ব্রণ দূর করার জন্য এটি একটি কার্যকর ঘরোয়া উপায়। ১০ থেকে ১৫ টি নিম পাতা ভালো ভাবে জলে ধুয়ে নিন। তারপর নিম পাতার সঙ্গে চন্দনের গুঁড়া ও হলুদ মিশিয়ে পিষে পেস্ট তৈরি করুন। এই পেস্ট মুখে মাস্কের মতো ৩০ মিনিট লাগিয়ে রাখুন। তারপর ঠান্ডা জল দিয়ে ভালো করে ধুয়ে ফেলুন। প্রতিদিন দুই সপ্তাহ ধরে এই পেস্টটি লাগালে ব্রণ দূর হবে।
৫. তিলের গুঁড়ো ও লেবু দিয়ে ব্রণ দূর করার উপায়-
লেবুর রসের সাথে ১ চা চামচ কালো তিল পিষে একটি পেস্ট তৈরি করে সারা মুখে লাগালে ব্রণ দূর হয়।
৬. দারুচিনি-
দ্রুত ব্রণ দূর করার আর একটি ঘরোয়া উপায় হলো দারুচিনির পেস্ট। আধা চা চামচ দারুচিনির গুঁড়ো মধুর সঙ্গে মিশিয়ে পেস্ট তৈরি করুন। তারপর যেখানে যেখানে ব্রণ আছে সেখানে এই পেস্ট লাগিয়ে রাত্রে ঘুমিয়ে পড়ুন। সকালে ঘুম থেকে উঠে ঠান্ডা জল দিয়ে মুখ ধুয়ে ফেলুন।
দারুচিনি রক্তে শর্করা ও ইনসুলিন কমায় এবং মুখের লোমকূপ বন্ধ হতে দেয় না।
দ্রুত ব্রণ এর দাগ দূর করার আধুনিক উপায়:
১. মাইক্রোনিডলিং (Microneedling)–
মাইক্রোনিডলিং এর মাধ্যমে ত্বকে সূক্ষ্ম সূচের সাহায্যে অতি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ছিদ্র করা হয়। এর ফলে ত্বকে কোলাজেন জমা হয়, ইলাস্টিক ফাইবার গঠিত হয় এবং ত্বক পুরু হয়, এবং পুনরুজ্জীবন লাভ করে। এতে ব্রণের দাগ দূর হয়।
২. মাইক্রোডার্মাব্রেশন (Microdermabrasion)–
মাইক্রোডার্মাব্রেশন চিকিৎসা পদ্ধতিতে ত্বকের উপরের স্তরটি আলতো করে সরিয়ে দেওয়া হয়। এটি ব্রণের দাগ দূর করতে এবং চামড়ার গর্ত নিবারণ করতে ব্যবহৃত হয়।
৩. লেজার স্কিন রিসারফেসিং (Laser skin resurfacing)-
মুখের বলিরেখা, ব্রণের দাগ দূর করতে লেজার স্কিন রিসারফেসিং পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। লেজার রশ্মি ত্বকের বাইরের স্তর (এপিডার্মিস) ধ্বংস করে এবং ভেতরের স্তর (ডার্মিস) গরম করে। যার ফলে কোলাজেন ফাইবার সঙ্কুচিত হয় এবং নতুন, মসৃণ, উজ্জ্বল ত্বক তৈরী হয়।
৪. সাবসিশন (Subcision)–
সাবসিশন হল ব্রণের দাগ দূর করার একটি সহজ এবং নিরাপদ সার্জারি পদ্ধতি।
ব্রণ কেন হয়?
আমাদের ত্বকে রয়েছে লোমকূপ বা ঘর্মগ্রন্থী। যদি অতিমাত্রায় তেল জাতীয় পদার্থ অথবা চামড়ার মৃত কোষ দ্বারা ঘর্মগ্রন্থী বন্ধ হয়ে যায়, তখন ত্বকের ভিতরে তেলজাতীয় পদার্থ আটকে গিয়ে ফুলে যায়। যাকে আমরা পিম্পল বলি। পিম্পল আস্তে আস্তে বড় আকার ধারণ করলে প্রদাহ বা জ্বালা সৃষ্টি হয়। এবং সেখানে ব্যাকটেরিয়া বাসা বাঁধে ও ইনফেকশন হয়ে যায়। এটিকেই আমরা ব্রণ বলি।
এছাড়া ব্রণ হওয়ার অন্যান্য কারণগুলি হল-
১. বয়ঃসন্ধিকালে বিশেষ হরমোনের ক্ষরণের কারণে ব্রণ হয়। ১৩-১৪ বছরের ছেলে-মেয়ে এই সমস্যায় ভোগে।
২. গর্ভাবস্থায় অনেক মহিলাদের মুখে ব্রণ বের হয়। কারণ গর্ভকালীন অবস্থায় হরমোন ক্ষরণ বৃদ্ধি পায়।
৩. অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা যেমন মাথাব্যথার কারণ তেমন ব্রণেরও কারণ। দুশ্চিন্তা হলে ব্রণ হবে। আর ব্রণ হলে দুশ্চিন্তা আরও বাড়বে।
৪. কিছু জীবাণু ও পরজীব ব্রণের জন্য দায়ী। ত্বকের পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার অভাবে এইসব জীবাণু ও পরাজিত সৃষ্টি হয়।
৫. অনেকের ক্ষেত্রে ব্রণ বংশগত। অর্থাৎ বাবা মায়ের ব্রণের সমস্ত থাকলে সন্তানেরাও এই সমস্যাই ভোগেন।
৬. ভুল খাদ্যাভ্যাসও ব্রণ সৃষ্টির একটি কারণ বলে দাবি করা হয়। অতিরিক্ত তেলে ভাজা খাবার এবং ফাস্ট ফুড অনেকের ক্ষেত্রে ব্রণের সমস্যাকে বাড়িয়ে দেয়।
ব্রণের প্রকারভেদ:
কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে ব্রণ একটি সাধারণ ত্বকের সমস্যা। শরীরের বিভিন্ন অংশে ব্রণ হতে পারে। বিশেষত মুখে, ঘাড়ে, পিঠে, এবং বুকে। এই ব্রণ বিভিন্ন প্রকারের হয় এবং প্রতিটি প্রকারের নির্দিষ্ট চিকিৎসা পদ্ধতি আছে। নিচে বিভিন্ন প্রকারের ব্রণ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো:
১. সাদা ব্রণ (Whiteheads)
সাদা ব্রণ হলো ছোট সাদা দাগ। এটা ত্বকের উপরিভাগে দেখা যায়। তেল জাতীয় পদার্থ অথবা ত্বকের মৃত কোষগুলি লোমকূপে আটকে গেলে এই ধরণের ব্রণ সৃষ্টি হয়। বাইরের বাতাসের সংস্পর্শে না আসায় এগুলি সাদা দেখায়। এই ধরণের ব্রণ সাধারণত খুব বেশি ব্যথাযুক্ত হয় না, কিন্তু অস্বস্তি বোধ হয়।
২. কালো ব্রণ (Blackheads)
কালো ব্রণ হলো ছোট কালো ফোঁটা, যা ত্বকের উপরিভাগে দেখা যায়। তেল জাতীয় পদার্থ অথবা ত্বকের মৃত কোষগুলি লোমকূপে আটকে গেলে এবং বাইরের বাতাসের সংস্পর্শে এলে, অক্সিজেনের সাথে বিক্রিয়া করে কালো হয়ে যায়। কালো ব্রণ হলে সাধারণত ব্যথা অনুভূত হয় না এবং সহজেই চিকিৎসা করা যায়।
৩. প্যাপিউল, পুস্টিউল বা নডিউল (Papules, Pustules, or Nodules)
এই ধরনের ব্রণ ত্বকের নিচে প্রদাহ বা সংক্রমণের কারণে তৈরি হয় এবং গুরুতর ক্ষত সৃষ্টি করে।
প্যাপিউল (Papules):
দেখতে ছোট, লাল, ফুলে যাওয়া ফুসকুনির মতো। এগুলি ব্যথাযুক্ত হতে পারে, তবে এগুলিতে কোনো পুঁজ সৃষ্টি হয় না।
পুস্টিউল (Pustules):
এগুলি পুঁজভর্তি ক্ষত। সাধারণত লাল রঙের হয় এবং উপরের দিকে সাদা বা হলুদ পুঁজ দেখা যায়। এই ধরনের ব্রণ প্রদাহের কারণে ঘটে এবং সংক্রমণের জন্য দায়ী।
নডিউল (Nodules):
এই ধরনের ব্রণ ত্বকের নিচের স্তরে দেখা যায়। শক্ত এবং ব্যথাযুক্ত হয়। এগুলোর চিকিৎসা করতে সময় লাগে এবং প্রায়শই দাগ থেকে যায়।
৪. সিস্ট (Cysts)
সিস্ট হলো পুঁজ ভর্তি ব্রণ। এগুলো নরম হয় এবং ব্যথা হতে পারে। এই ধরনের ব্রণ ত্বকের গভীর স্তরে তৈরি হয় এবং প্রদাহ বা সংক্রমণের কারণে ঘটে। সিস্ট সাধারণত আকারে বড় হয় এবং অন্য ধরনের ব্রণের তুলনায় সবচেয়ে মারাত্বক এবং ব্যথাযুক্ত। এগুলিতে সাধারণত দাগ থেকে যায় এবং চিকিৎসার জন্য চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া প্রয়োজন।
হালকা ব্রণের ক্ষেত্রে সাধারণত ঘরোয়া উপায় অবলম্বন করা যেতে পারে। তবে গুরুতর ক্ষেত্রে ডার্মাটোলজিস্টের পরামর্শ নেওয়া উচিত। ত্বকের পরিচর্যা করলে, সঠিক খাদ্যাভ্যাস মেনে চললে এবং পর্যাপ্ত পরিমাণ জল পান করলে ব্রণের সমস্যা এড়ানো যেতে পারে।
দ্রুত ব্রণ দূর করার উপায় সম্পর্কে FAQs: Frequently Asked Questions
১. ব্রণ কি ছোঁয়াচে?
উত্তর: একদম না। ব্রণ ছোঁয়াচে নয়। ব্রণ বেরিয়েছে এমন ব্যক্তির সংস্পর্শে এলে কখনোই ব্রণ হয় না।
২. কি খেলে ব্রণ দূর হয়?
উত্তর:
ফল ও সবজি আপেল, শশা, স্ট্রবেরি, লেবু, কাজু, মুলো, পালং শাক, ব্রকলি, গাজর, টমেটো, মেথি পাতা, পেয়াজ, লাউ ইত্যাদি।
প্রোটিন উৎস মাছ, চিকেন, ডিম, মুগ ডাল, ছোলা, সোয়াবিন, পনির, দুধ, সোয়া মিল্ক, দই ইত্যাদি।
অন্যান্য নারিকেল, তিল, সুন্দরী তেল, গোলমরিচ, হলুদ ইত্যাদি।
৩. সাধারণত কত বছর বয়সে ব্রণ বের হয়?
উত্তর: সাধারণত ব্রণ কিশোর বয়সে, অর্থাৎ ১২ থেকে ১৮ বছর বয়সের মধ্যে বেশি দেখা যায়। এই বয়ঃসন্ধিকালে হরমোনের পরিবর্তন ঘটে, বিশেষত পুরুষ ও মহিলাদের যৌন হরমোনের (যেমন অ্যান্ড্রোজেন) মাত্রা বৃদ্ধি পায়, যা ত্বকের তেল গ্রন্থিকে বেশি সক্রিয় করে তোলে এবং তেল উৎপাদন বাড়ায়। এর ফলে ত্বকের লোমকূপ বন্ধ হয়ে যায় এবং ব্রণ সৃষ্টি হয়।
তবে, ব্রণ যে কোনো বয়সে হতে পারে। কিছু মানুষের ক্ষেত্রে প্রাপ্তবয়স্ক বয়সেও (১৮-৩০ বছর বা তার বেশি) ব্রণের সমস্যা দেখা যায়।
Disclaimer:
এখানে দেওয়া তথ্য শুধুমাত্র সাধারণ জ্ঞানের জন্য। এটি কোনো পেশাদার চিকিৎসকের পরামর্শের বিকল্প নয়। কোনো কিছু গ্রহণ করার আগে অবশ্যই আপনার চিকিৎসকের পরামর্শ নেবেন।